হাজার বছরের প্রাচীন মধুপুর শালবন। ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলের পর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন মধুপুর শালবন। এ বনকে দেশের মধ্যাঞ্চলীয় বনভূমি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ বনের বিস্তৃতি গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অংশজুড়ে। একসময় রাজধানী ঢাকার কাঁটাবন পর্যন্ত এ বনের সীমানা থাকলেও আজ তা শুধুই অতীত, বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস। টাঙ্গাইল ও মোমেনশাহী জেলার অংশটুকু মধুপুর গড় বা শালবন নামে পরিচিত। শালগাছের মোলা বা শিকড় থেকে গজানো চারায় গাছ হয় বলে স্থানীয়রা একে গজারি বনও বলে থাকে।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর স্থানগুলোর মধ্যে মধুপুর গড় অন্যতম। এ বনের প্রধান আকর্ষণ গজারি গাছের সমারোহ, যে কারণে এটি শালবন নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, কয়েকশ বছরের পুরোনো বন এটি, যা বন বিভাগের অধীনে আসে ১৯৬২ সালে। বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৪ সালের বন্য প্রাণী আইনের আওতায় মধুপুর বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। এর আয়তন ৮৪৩৬৬ হেক্টর প্রায়। মধুপুর জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশী নদী। এ
উদ্যানের ভেতরে ও আশপাশের প্রায় ১৮৭টি গ্রামে বসবাস করে গারো, কোচ, বামনসহ নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
মধুপুর জাতীয় উদ্যানে আছে ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮ প্রজাতির পাখি ও কয়েক প্রজাতির উভচর প্রাণীর বসবাস। এ বনের বাসিন্দা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখপোড়া হনুমান, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, লালমুখ বানর, বন্য শূকর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বনে দেখতে পাওয়া পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্ট্রুর্ক বিলড কিংফিশার বা মেঘ হু, মাছরাঙা, খয়রা গেছো পেচা, কাঠময়ূর, বনমোরগ, মুরগি। এ বনের মধ্যে লহরিয়া বন বিট কার্যালয়ের কাছে হরিণ প্রজনন কেন্দ্রে আছে বেশ কিছু হরিণ। পাশেই সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে, যার চূড়ায় উঠে উপভোগ করতে পারবেন বহুদূর পর্যন্ত বনের সৌন্দর্য। এ জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি হনুমানের দেখা মেলে। নানা গাছপালায় সমৃদ্ধ জাতীয় এ উদ্যান। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাল, বহেড়া, আমলকী, হলুদ, আমড়া, জিগা, ভাদি, অশ্বত্থ, বট, সর্পগন্ধা, শতমূলী, জায়না, বিধা, হাড়গোজা, বেহুলা ইত্যাদি। এ ছাড়া নানা প্রজাতির লতাগুল্ম আছে এ বনে।
মধুপুর উপজেলা সদর থেকে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ রোডে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে এগুলোই রসুলপুর মাজার এলাকায় মহাসড়কের বাঁ পাশে পেয়ে যাবেন মধুপুর জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের প্রধান ফটক। সেখানে আপনি পৌঁছাতে পারেন নিজস্ব গাড়িতে কিংবা সিএনজি, ইজিবাইক বা ভাড়া করা গাড়িতে।
ফটক দিয়ে গহিন জঙ্গলে প্রবেশ করে ইট বিছানো সর্পিল পথ ধরে একটু এগোলেই মধুপুর জাতীয় উদ্যান রেঞ্জ কার্যালয় ও সহকারী বন সংরক্ষকের কার্যালয়। আরো গহিনে প্রবেশ করতে অনুমতি নিয়ে নিতে হবে এখান থেকেই। উদ্যানের প্রবেশপথ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরেই দোখলা পিকনিক স্পট, রয়েছে জলই ও মহুয়া নামের দুটি বিশ্রামাগার। চলতি পথে আপনার চোখে পড়বে বনের চোখধাঁধানো সৌন্দর্য, কিংবা দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো বন্য প্রাণীর সঙ্গে। তখন আপনি পুলকিত না হয়ে পারবেন না। সেখান থেকে একটু দূরেই পাবেন দোখালা রেস্ট হাউজ, যেখানে বসে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান। আরো পাবেন চুনিয়া আর বকুল নামে দুটি মনোরম কটেজ। এগুলো আপনি ইচ্ছা করলে দিয়ে রাখতে পারেন অগ্রিম বুকিং এবং আস্বাদন করতে পারেন জঙ্গলে রাত্রিযাপনের এক সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। রেস্টহাউসের পূর্বপাশ জুড়ে তেঁতুল আর আমলকীর বন। দখিনের সড়ক আপনাকে নিয়ে যাবে রাবার বাগান অবধি।
পিকনিক স্পটের খোলা চত্বরে অবস্থিত সাইডভিউ টাওয়ারে উঠে লুফে নিতে পারবেন বনের বিশাল অঞ্চলের সৌন্দর্য। আরেকটু দূরে ঘুরে আসতে পারেন বনের জুঁই ও চামেলি নামক পিকনিক স্পটে। উল্লেখ্য, যে বনের দ্বিতীয় প্রবেশপথ পঁচিশমাইল; রসুলপুর থেকে যার দূরত্ব প্রায় নয় কিলোমিটার। তবে প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করাই শ্রেয়, কারণ এখান দিয়ে গেলেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন বনের প্রকৃত সৌন্দর্য।
এগুলো দেখা শেষ হলে আরেকটু এগোন, দেখতে পাবেন একেবারে ঝকঝকে তকতকে পাহাড়ি ঘরবাড়ি, আঙিনায় হরেক রকম ফুলের বাগান। না, এগুলো কোনো পিকনিক স্পট নয়। এগুলো হচ্ছে গারো পল্লী। সেখানেই পীরগাছা ক্রাইস্ট মিশন ও গির্জা, গারো কালচারাল সেন্টার ও আদিবাসী পোশাক বিক্রয় কেন্দ্র। ইচ্ছে হলে কিনে নিতে পারেন আপনিও। মিশন থেকে আরো পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরুলে শোলাকুড়ি গ্রামের সুলতানি আমলের সামন্ত রাজা ভগবৎ দত্তের বিশাল দিঘি।
দেড় হাজার একরের বিশাল দীঘির পাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন মন্দির, যেখানে বৈশাখের পূর্ণিমায় বসে শিব পূজা ও রাসমেলা। এখানে আছে সাত হাজার একরের সরকারি রাবার বাগান। খুব ভোর থেকেই শ্রমিকরা গাছের বাকল কেটে সংগ্রহ করে কাঁচা রাবার। সন্তোষপুর রাবার বাগানে যেতে চোখে পড়বে বিএডিসির সুদৃশ্য কাকরাইদ ক্যাম্পাস। ১০০ গজ সামনেই জয়তেঁতুল গ্রামের পাহাড়ি ঝরনা। কয়েক কিলোমিটার সামনেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সাগরদীঘি ও শতাব্দীপ্রাচীন হিজলতলা মন্দির।
কাকরাইদ থেকে ময়মনসিংহ সড়ক ধরে এগুলে বন গবেষণা কেন্দ্রের ভেষজ উদ্যান, বৈষ্ণবদের আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী সনাতন মন্দির, জলছত্র ক্রাইস্ট মিশন, বেলজিয়ামের অনুদানে নির্মিত বৃহত্তম কুষ্ঠ ব্যাধি হাসপাতাল, কারিতাস সিল্ক ফ্যাক্টরি ও শোরুম। আরো সামনে রসুলপুর বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জের সুদৃশ্য চত্বর ও হজরত জয়েনশাহী পীরের মাজার। এতকিছু একবারে দেখার সুযোগ আসলে খুব কমই মেলে।
মনে রাখবেন
জঙ্গলে ভ্রমণের সময় অবশ্যই আরামদায়ক কাপড় ও জুতো পরবেন, সঙ্গে রাখবেন রোদ চশমা, টুপি এবং পানির বোতল। বর্ষাকালে ভ্রমণে এলে সাথে রাখবেন রেইনকোট। দূরের পাখি দেখতে আনতে পারেন দুরবিন। জোঁক কিংবা কীটপতঙ্গ আপনার আনন্দের মধ্যে নুন ছিটাতে পারে। তাই প্যান্ট অবশ্যই গুজে নিন মোজার ভেতর আর সঙ্গে রাখুন পতঙ্গনাশক ক্রিম। বনের ভেতর একা না যাওয়াই শ্রেয়। পশুপাখি বিরক্ত হয় এমন শব্দ ও কোলাহল করা থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে এবং পলিথিন, ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে কোনোভাবেই বনকে ময়লা করবেন না এবং ধূমপানও করবেন না।
যাতায়াত
রাজধানী থেকে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার উত্তরেই মধুপুরের গড়, যা চোখে পড়বে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডে মধুপুর পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই। ঢাকা থেকে মধুপুর যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। ঢাকার মহাখালী বাসস্টেশন থেকে বিনিময় ও শুভেচ্ছা পরিবহনের বাস চলে এ পথে, যা পাওয়া যাবে দিনের যেকোনো সময়। ভাড়া মাত্র ১৫০-২০০ টাকা। গড়ের দূরত্ব টাঙ্গাইল সদর থেকে মাত্র ৪৭ কিলোমিটার এবং মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রান্তিক বাসে মাত্র ১০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারবেন গড়ে।
থাকার জায়গা
পর্যটকদের নিরাপদে থাকার জন্য এখানে রয়েছে আরামদায়ক ব্যবস্থা। বনে অবস্থিত জলই, মহুয়া, জুঁই ও চামেলি কটেজে পিক সিজনে ৬০০, অব সিজনে ৩০০ টাকায় থাকতে পারবেন। জঙ্গলে রাত যাপন করতে চাইলে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন অফিসে বুকিং দিতে পারেন আগেই, সেখানে রয়েছে ভিআইপি দোখলা বাংলো। তা ছাড়া মধুপুর উপজেলা সদরে আদিত্য, সৈকত এবং ড্রিমটাচ নামের তিনটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এগুলোতে রয়েছে এসি এবং নন এসি রুমের সুন্দর ব্যবস্থা।
তাহলে আর দেরি কেন? এবারের ঈদকে আনন্দময় এবং স্মরণীয় করতে পরিবার-পরিজনসহ ঘুরে আসুন সবুজ মধুপুর গড়ে, মিশে যান প্রকৃতির রাজ্যে।